অদৃশ্য ভালোবাসা ও একটি ডিভোর্স

সেদিন অনেক রাত করে বাসায় ফিরলাম। ডায়নিং টেবিলে আমার স্ত্রী যখন রাতের খাবার পরিবেশন করছিল তখন আমি তার হাতে হাত রেখে বললাম, তোমার সাথে কিছু কথা আছে। সে আমার সামনের চেয়ারে বসল, বিরস চিত্তে নিরবে খাওয়া দাওয়া করছিল।

আমি তার নিষ্প্রাণ চোখে চাপা কষ্ট দেখতে পেলাম। কিভাবে কথা শুরু করবো সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, নিরব সময়টুকু তাকে অবচেতন মনে দিয়ে দিলাম, যাতে সে তার মনের মধ্যেই কিছুটা আঁচ করতে পারে।

এক সময় নিরবতা ভেঙ্গে বলেই ফেললাম, আমি ডিভোর্স চাই। আমার কথায় তার মধ্যে তেমন কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম না, সে স্বাভাবিক ভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কেন?

Read more: অদৃশ্য ভালোবাসা ও একটি ডিভোর্স

আয়কর রিটার্ন তৈরীর সহজ কৌশল।

এই ছোট প্রশ্নের তেমন কোন যৌক্তিক উত্তর আমার কাছে সে সময় ছিলনা, আমি চুপ করে থাকার কারনে সে রেগে গেল কিছুটা, এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি একটা কাপুরুষ।

এটাই ছিল সে রাতে তার শেষ কথা আমার সাথে, কারন আমি আসলেই এই ডিভোর্স চাওয়ার কোন উপযুক্ত কারন দাঁড় করাতে পারছিলাম না, শুধু এতোটুকুই আমার মাথায় আসছিলো, আমি আরেকজনকে ভালবেসে ফেলেছি, আমার হৃদয় এখন জেনিফারের কাছে। গত কদিন ধরে আমি আমার স্ত্রীর জন্য এক ফোঁটাও ভালবাসা অনুভব করিনি, কিন্তু আজকে তার জন্য আফসোস হচ্ছে।

হঠাৎ করেই আমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ জেগে উঠলো, আমার স্ত্রীর প্রতি কোন ভালবাসা না থাকলেও কোনরকম ঘৃণা ছিল না। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে আমি তার কোন আচরণে তেমন মনক্ষুণ্ণ হয়েছি বলে মনে পড়ে না।

ডিভোর্স সেটেলমেন্টে তাকে আমার বাড়ি, একটা গাড়ি আর আমার কোম্পানির ২৫% শেয়ার দিয়ে তার হাতে এগ্রিমেন্ট পেপার দিলাম। সে সেটা কিছুক্ষণ দেখে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলল। আমি তাকে বললাম, “তুমি ভুল করছ, আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে সম্পত্তি দিয়েছি, আমি চাই তুমিও তোমার নতুন জীবনে সুখি হও”। এবার সে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে আমার সামনে কেঁদে ফেলল, যেটা আমি চাইছিলাম। গত কদিন ধরে যে চিন্তাগুলো আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, এখন আমি বুঝতে পারছি আমার ডিভোর্স পেতে আর তেমন কোন কষ্ট হবে না।

পরদিন আমি অফিস থেকে বাসায় পৌঁছে দেখলাম আমার স্ত্রী কি যেন লিখছে, আমি ক্লান্ত ছিলাম, সারাদিন জেনিফারের সাথে ভালই কেটেছে, বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। তাই ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে সে আমাকে তার ডিভোর্স কন্ডিশন দিল, তাতে লেখা ছিল সে এক মাস সময় চায়, আর এই এক মাসে যতটা সম্ভব আমার সাথে সাধারণ ভাবে কাঁটাতে চায়। কারন হিসেবে বলল, আগামী মাসে আমাদের একমাত্র ছেলের পরীক্ষা, তাই সে কোন মতেই চায় না এই ডিভোর্সের কারনে তার পরীক্ষার কোন ক্ষতি হোক।

তার এই চাওয়াগুলো খুবই স্বাভাবিক ছিল, তাই আমি তাতে রাজী হয়ে গেলাম। কিন্তু আরেকটি জিনিষ যেটা সে ডিভোর্স কন্ডিশনের একদম নিচে লিখেছিল, অবাক করার মত একটি অনুরোধ, সেটি হচ্ছে আমি যেভাবে আমাদের বিয়ের রাতে তাকে কোলে নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকেছিলাম, সেই একই ভাবে আগামী এক মাস তাকে বেডরুম থেকে লিভিং রুম পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে প্রতিদিন সকালে।

আমি জেনিফারকে আমার স্ত্রীর এই আজব ইচ্ছের কথা বললাম, সে হাঁসতে হাঁসতে বলল, তোমার স্ত্রী যত বুদ্ধিই করুক, ডিভোর্স তাকে দিতেই হবে, তুমি আমার হবেই।

ডিভোর্সের যাবতীয় বিষয় খোলাসা হবার পর থেকে তার সাথে আমার সব রকম যোগাযোগ অনেকটা বন্ধ হয়ে গেল। প্রথম দিন যখন তাকে আমি কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলাম, আমার একটু কষ্ট হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো আমায় বয়স ধরে ফেলেছে কিছুটা।

সে আমার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বলছিল, ছেলে কে ডিভোর্সের ব্যাপারে কিছু বলার দরকার নেই। আমি নিরবে সায় দিলাম। এমন সময় আমার ছেলে পেছন থেকে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলো, “আব্বু আম্মুকে কোলে নিয়েছে” আর হাততালি দিচ্ছিল, শেষ কবে তাকে এমন উৎফুল্ল দেখেছিলাম মনে করার চেষ্টা করলাম, তার কথা আমার শিরদাঁড়ায় একটা শিহরণ বয়ে নিয়ে গেল।

কোথায় যেন একটা খারাপ লাগা অনুভব করলাম, কিন্তু এর উৎস তখন বুঝতে পারছিলাম না। এরপর তাকে লিভিং রুমে নামিয়ে দিলাম, সে সকালের নাস্তা রেডি করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। এরপর খাওয়া দাওয়া সেরে তৈরি হয়ে আমি অফিসের উদ্দেশে বেড়িয়ে গেলাম, সেও তার কাজে চলে গেল।

দ্বিতীয় দিন আমরা আরও স্বাভাবিক আচরণ করলাম, যখন তাকে কোলে তুলে নিলাম, সে আমার বুকে মাথা রাখল, আমি তার মৃদু গন্ধ পাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হচ্ছিল, আমি এই মহিলার দিকে অনেকদিন এভাবে মনোযোগ দেইনি।

বুঝতে পারলাম, সে আর আগের মত যুবতী নেই, তার চেহারায় হাল্কা ভাঁজ পড়েছে, তার দুএকটি চুল সাদা হয়েছে। আমাদের সংসারের যত ওজন সব মনে হচ্ছিলো সে একাই এতোদিন বহন করেছে। কিছুক্ষণের জন্য একটু অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিলাম, আমি তার সাথে এতোদিন যে অন্যায়গুলো করেছি।

চতুর্থ দিন যখন তাকে কোলে নিলাম, তখন মনে হচ্ছিলো আমাদের সেই পুরনো দিনগুলোর কথা, আমার স্ত্রীর প্রতি সেই পুরনো আকর্ষণ ফিরে আসছে অনুভব করছিলাম আমি। এইতো সেই মহিলা, যে তার জীবনের বিগত দশটি বছর আমার সাথে সংসার করেছে।

পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিনে লক্ষ্য করলাম, আমার স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে, যদিও জেনিফারকে এ বিষয়ে কিছুই বলিনি। যতই দিন যাচ্ছিলো, আমার স্ত্রীকে কোলে নেয়ার বিষয়টা ততই সহজ মনে হচ্ছিলো, হয়তো বিগত দিনগুলোর কারনে অভ্যস্ত হয়ে পরছিলাম অথবা নিজের কাছেই ভাল লাগছিল।

এরমধ্যে একদিন সকালে দেখলাম সে তার ড্রেসগুলো পড়ে দেখছিল আর বলছিল সবগুলো ড্রেস এখন বড় হয়। আমি লক্ষ্য করলাম সে শুঁকিয়ে যাচ্ছে, তখন বুঝতে পারলাম কেন এখন তাকে কোলে নেয়াটা সহজ হয়ে গিয়েছে। আবারও সেই মৃদু ব্যাথা অনুভব করলাম, এতো কষ্ট যে নিরবে সহ্য করে নিয়েছে, অবচেতন মনেই আমি তার কাছে গেলাম, তার মাথায় হাত রাখলাম। এমন সময় আমার ছেলে আসলো, আমাকে বলতে লাগলো, আব্বু এবার আম্মুকে কোলে নেয়ার সময় হয়েছে।

প্রতিদিন সকালে তার মাকে কোলে নেয়ার ব্যাপারটা তার কাছে এখন সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। আমার স্ত্রী তাকে কাছে ডাকল, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। আমি অন্য দিকে ফিরে রইলাম, ভয় হচ্ছিলো যদি আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে দূরে সরে যাই। এরপর বিগত দিনগুলোর মত তাকে কোলে তুলে নিলাম, সে আমার গলায় জড়িয়ে ধরল, আমিও তাকে বুকের মধ্যে আরও আগলে ধরলাম, মনে হচ্ছিলো আমি আমার বিয়ের প্রথম রাতে আবার ফিরে গিয়েছি। এর সাথেই তো আমি আমৃত্যু থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।

শেষদিন তাকে আরও হাল্কা মনে হচ্ছিলো, তার জন্য আমি মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করছিলাম। প্রতিদিনের মতই তাকে লিভিং রুমে নিয়ে গেলাম, তার চোখের কোনে দুফোঁটা অশ্রু দেখতে পেলাম কিন্তু ঠোঁটে মৃদু হাঁসি। আমি তাকে শেষ চুমু খেলাম, কত দিন পর জানি না। ও আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল। এরপর অফিসের উদ্দেশে বেড়িয়ে গেলাম। অফিস শেষ করে বাসায় পৌঁছানোর সময় জেনিফারকে ফোন দিলাম, বললাম আমি দুঃখিত, তোমাকে আমি বিয়ে করবো না আর আমার স্ত্রীকেও আমি ডিভোর্স দিবো না। জেনিফার কিছু বলার আগেই আমি ফোন রেখে দিলাম।

বাসায় পৌঁছে আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি ডিভোর্স চাই না। ও প্রথমে একটু চমকে উঠলো, তৎক্ষণাৎ আমাকে জোরে একটা থাপ্পড় দিলো, তারপর বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আমি সাথে সাথে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম, একটা ফুলের দোকানে গেলাম, ওর পছন্দের সমস্ত ফুল দিয়ে একটা বুকেট বানালাম। সেলসগার্ল জিজ্ঞেস করলো, গিফট কার্ডে কি লিখবো। আমি বললাম, “যতদিন মৃত্যু আমাদের আলাদা না করে, ততদিন আমি প্রতিদিন তোমাকে কোলে নিয়ে যাবো”। এরপর ওর পছন্দের চকলেট কিনলাম। এরপর বাসার উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম।

গল্প এখানে শেষ হয়ে গেলেই ভাল হত।

বাসায় ফিরলাম হাতে আমার স্ত্রীর জন্য উপহার আর মুখে একটা তৃপ্তির হাঁসি নিয়ে, শুধুমাত্র তাকে নিরব নিথর অবস্থা খাটে পড়ে থাকতে দেখার জন্য। সে গত কয়েক মাস ধরেই ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে চলেছিল, যেটা আমি বুঝতে পারিনি বা আমাকে বুঝতে দেয় নি। আমার স্ত্রী জানতো তার হাতে আর বেশী দিন সময় নেই, অথচ সে কখনো চায়নি আমার ও জেনিফার সম্পর্ক আমাদের সন্তানের মনে আমার বিরুদ্ধে কোন প্রকার ক্ষোভ সৃষ্টি হোক। তাইতো জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত সে আমাকে প্রমান করে গেল, আমি একজন ভাল স্বামী ছিলাম।

অনলাইনে রিটার্ন দিতে এখানে ক্লিক করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *